সিলেট ২৮শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

সকলের অগোচরে ফ্যাসিবাদী সরকারের কারিকুলাম কি আবার ফিরে আসছে : মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ০৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ
সকলের অগোচরে ফ্যাসিবাদী সরকারের কারিকুলাম কি আবার ফিরে আসছে : মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

সকলের অগোচরে ফ্যাসিবাদী সরকারের কারিকুলাম কি আবার ফিরে আসছে? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি’র কার্যক্রম থেকে এমন আশংকা হচ্ছে। 

সম্প্রতি দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হিসাবে সারাদেশে পঁয়ষট্টি হাজারের অধিক সঙ্গীতের শিক্ষক নিয়োগ পাবেন।  কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ক্লাসের বর্তমান পাঠ্যসূচিতে সঙ্গীত বিষয়টি নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাহলে সঙ্গীতের শিক্ষক কোন বিষয়ের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার তাদের গৃহীত বিতর্কিত কারিকুলামে সঙ্গীত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং এর আলোকে ‘সহকারী শিক্ষক (সঙ্গীত)’ পদ সৃষ্টি করে সে পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ইতোমধ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন হয়। পরবর্তীতে তাদের বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল করে পূর্ববর্তী (২০১২ সালের) কারিকুলামে ফিরে যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উক্ত কারিকুলামের আলোকে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকও ছাপা হয়।  কিন্তু বর্তমান সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা কারিকুলামের পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি। তারা ভেতরে ভেতরে বিগত সরকারের বিতর্কিত কারিকুলাম ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে কাজ করতে থাকে এবং এক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফলতার দ্বারপ্রান্তে।

শ্রেণিতে পঠিত বিষয় ছাড়া কিভাবে সঙ্গীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলো তা খুঁজতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়া’র মতো অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে। পাঠকমাত্রই জেনে আশ্চর্য হবেন যে, সরকারের ভেতর থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা আওয়ামী কারিকুলামকে নতুন মোড়কে আবার চূড়ান্ত করেছে। “জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১-প্রাথমিক স্তর (পরিমার্জিত ২০২৫)” শিরোনামে তারা এ কারিকুলাম চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক চারু ও কারুকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক অন্তর্ভুক্ত করেছে। শিল্পকলা শিরোনামে প্রত্যেক শ্রেণির জন্য ৪টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো হলো: (১) শিল্পকলা (চারু ও কারুকলা), (২) শিল্পকলা (সঙ্গীত), (৩) শিল্পকলা (নৃত্যকলা), (৪) শিল্পকলা (নাট্যকলা)। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা’র (ইসলাম শিক্ষা, হিন্দুধর্ম শিক্ষা, বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা ও খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা) বাইরে সামাজিক বিজ্ঞান এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ কারিকুলাম সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রস্তুতকৃত কারিকুলাম, যা কেবল পরিমার্জনের নাম দিয়ে নতুন মোড়কে চূড়ান্ত করা হয়েছে। একইভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত।

উল্লেখ্য যে, ২৮ আগস্ট, ২০২৫ ইং তারিখে “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫” নামে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ৩১ আগস্ট ২০২৫ ইং তারিখে আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উক্ত বিধিমালার আলোকে নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে। উক্ত বিধিমালায় নতুন পদ হিসাবে সহকারী শিক্ষক (সঙ্গীত) ও সহকারী শিক্ষক (শারিরীক শিক্ষা) নামে দুটি পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি ফ্যাসিবাদী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল। বিগত সরকার তাদের বিতর্কিত কারিকুলামের আলোকে ২০২২ সালের ৮ মে উপরোক্ত দুটি পদ সৃজন করে সার্কুলার জারি করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আওয়ামীলীগের পতনের পর যে কারিকুলাম বাতিল হলো, এরই উপর ভিত্তি করে আবার নতুন কারিকুলাম হয় কী করে? কীভাবে ঐ কারিকুলাম আবার নতুন মোড়কে উপস্থাপিত হয় এবং কীভাবে এর আলোকে শিক্ষক নিয়োগ বিধি চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি হয় এটি খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের গণমানুষকে অন্ধকারে রেখে অতীতের কারিকুলাম আবার ফিরে আসলে এর দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে। সুতরাং এ বিষয়ে সরকারের সুষ্পষ্ট বক্তব্য জনগণ আশা করে।

“সরকারের কাছে দেশের সচেতন মানুষের দাবি”

▪️ “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫” সংশোধনপূর্বক সঙ্গীতের শিক্ষক (সহকারী শিক্ষক সঙ্গীত) নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

▪️ দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেখানে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে সেখানে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উপরোক্ত বিধিমালায় তা অবিলম্বে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রকাশ থাকে যে, দীর্ঘদিন থেকে দেশের সচেতন নাগরিক ও অভিভাবকগণ ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছেন।

▪️ বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে যেহেতু শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত নেই সেহেতু বিষয় বহির্ভুত শিক্ষক হিসাবে ‘সহকারি শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)’ নিয়োগের সিদ্ধান্তও বাতিল করতে হবে। এর পরিবর্তে গণিত বা ইংরেজিতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

▪️ সর্বোপরি বিতর্কিত জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ এর আলোকে গৃহীত “জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১-প্রাথমিক স্তর (পরিমার্জিত ২০২৫) এবং “প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০২২ (পরিমার্জিত ২০২৫)” অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বকীয়তা রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও করণীয় আছে। আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের মানুষকে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় আবারো জেগে উঠতে হবে। কোনো অবস্থাতেই পূর্বের বিতর্কিত কারিকুলাম আবার যেন ফিরে না আসে সে বিষয়ে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না আসলে জাতিকে আবারো অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে।